ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুঁ ও কিয়ামতের ভয়াবহতা

প্রধান চার ফেরেশতার মধ্যে ইসরাফিল দ্বিতীয়। তাঁর দায়িত্ব আল্লাহর নির্দেশে কিয়ামতের দিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া।
পৃথিবী, মহাবিশ্ব ও মানব সভ্যতার যেমন একদিন সূচনা হয়েছিল তেমনি একদিন এর পরিসমাপ্তিও ঘটবে। আল্লাহর
আদেশে ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে এক ভয়াবহ মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে সব কিছুর সমাপ্তি হবে।
ইসরাফিলের ফুৎকার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেই দিনের অবস্থা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কোরআন ও
হাদিসে এর বিবরণ উল্লেখ হয়েছে। সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা হলো।

ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গা

আরবি ‘সুওর’ শব্দের অর্থ শিঙ্গা। কোরআন ও হাদিসে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ শিং বা চোঙা। হজরত আব্দুল্লাহ
ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর কাছে একবার একজন বেদুঈন এসে জিজ্ঞাসা
করল শিঙ্গা কী? রাসুল (সা.) বললেন, তা হচ্ছে শিং, কেয়ামতের সময় তাতে ফুৎকার দেওয়া হবে।’
(তিরমিজি : ২৪৩০; মুসনাদে আহমাদ: ৬৫০৭)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন,
‘শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা (ইসরাফিল আ.) প্রথম দিন থেকেই শিঙ্গায় নিয়ে তটস্থ হয়ে আছেন। ভীতসন্ত্রন্ত অবস্থায় আরশের দিকে লক্ষ রাখছেন। কখন তাকে আদেশ দেওয়া হবে। আদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি
তার দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি এমনভাবে তাকিয়ে আছেন, তার চোখ দুটো যেন দুটো ঘূর্ণায়মান নক্ষত্র গোলক।’ (মুসতাদরাকে  হাকেম : ৮৬৭৬; সিলসিলাতুস সাহিহা, আলবানি : ১০৭৮)
শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার সময়কাল:
পৃথিবীর জনজীবন খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকবে। হঠাৎ একদিন শিঙ্গার আওয়াজ বেজে উঠবে। হাদিসে এসেছে,
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সূর্যের উদয় হয় এমন সব দিনের ভেতর সবচেয়ে উত্তম দিন
হচ্ছে শুক্রবার। এ দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিনে তিনি জান্নাত থেকে বের হয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছেন,
এ দিনে তার তওবা কবুল করা হয়েছে, এ দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, এ দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে।’ (নাসায়ি :
১৪৩০; মুসনাদে আহমাদ : ১০৩০৩)

ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় ফুৎকারের দিন মানুষের অবস্থা:

সেদিন সকালে লোকেরা আপন আপন কাজে ব্যস্ত থাকবে। হঠাৎ সূক্ষ তবে দীর্ঘ একটি আওয়াজ সবাই শুনতে পাবে।
সব স্থানের মানুষ সমানভাবে এই আওয়াজ শুনবে। সবাই অবাক হয়ে ভাববে এই আওয়াজ কীসের? কোথা থেকে আসছে?
সে আওয়াজ ক্রমেই হালকা থেকে কঠিন ও বজ্রপাতের মতো উঁচু ও তীব্র হতে থাকবে। এর কারণে মানুষের মাঝে ভীষণ অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা দেখা দেবে। যখন আওয়াজ পুরোপুরি তীব্র হয়ে যাবে তখন মানুষ ভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকবে।
যার যার কাজ ফেলে পরিবারের লোকদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
কিন্তু পরিবার-আপনজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তাদের সম্পদের অসিয়ত করার এবং নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে আসার অবকাশও পাবে না।’ (সুরা ইয়াসিন : ৪৯)।
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রথম যে ব্যক্তি শিঙ্গার আওয়াজ শুনবে সে তার উটের পানি পান করার জন্য হাউজ মেরামতে ব্যস্ত থাকবে। এমতাবস্থায় সে শিঙ্গার আওয়াজ শুনতে পাবে এবং বেহুঁশ হয়ে পড়বে।’ (মুসলিম: ২৯৪০)।
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামত অবশ্যই কায়েম হবে। তা এমন সময় যে, কাপড়ের দোকানে ক্রেতা বিক্রেতার সামনে কাপড় দেখার জন্য মেলে ধরবে, কিন্তু দরদামও শেষ করতে পারবে না, কাপড় গুটাতেও পারবে না; এক ব্যক্তি দুধ দোহন করে ঘরে নিয়ে বসবে, কিন্তু তা পান করতে পারবে না; এক ব্যক্তি হাউজ মেরামত করবে, কিন্তু তা থেকে পানি পান করতে পারবে না;
এক ব্যক্তি লোকমা তুলবে, কিন্তু তা মুখে দিতে পারবে না এমন অবস্থায় কেয়ামত কায়েম হবে।’ (বুখারি : ৬৫০৬)। অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকবে, এমন সময় আকস্মিকভাবে পৃথিবী ধ্বংসের বাঁশি বেজে উঠবে।

ঈসরাফিল আঃ এর শিঙ্গায় ফুৎকারের ভয়াবহতা:

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। সেটা হবে অনেক কঠিন দিন।’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৮-৯)। আরও
বলেন, ‘শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে। ফলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া আসমানসমূহে যারা আছে এবং পৃথিবীতে
যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে পড়বে।’ (সুরা জুমার : ৬৮)। আরও বলেন, ‘যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে- একটি মাত্র ফুঁক;
তখন জমিন ও পর্বতমালাকে উড়ানো হবে। মাত্র একটি আঘাতে সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। ফলে সে দিন মহাপ্রলয় সংঘটিত
হবে। আসমান বিদীর্ণ হয়ে যাবে। ফলে সেদিন তা হয়ে যাবে দুর্বল বিক্ষিপ্ত। ফেরেশতারা আসমানের বিভিন্ন প্রান্তে থাকবে।
সেদিন তোমার রবের আরশকে আটজন ফেরেশতা তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। তোমাদের কোনো গোপনীয়তাই গোপন থাকবে না। (সুরা আল হাক্কাহ, আয়াত ১৩-১৮)। ‘সেদিন জমিন ও পর্বতমালা
প্রকম্পিত হবে এবং পাহাড়গুলো চলমান বালুকারাশিতে পরিণত হবে।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ১৪)। সেদিন ভূপৃষ্ঠ অনেক ভয়ঙ্করভাবে দুলতে থাকবে। ভূমিকম্পের ভয়াবহতায় মাটির নিচ থেকে সব স্বর্ণমুদ্রা বের হয়ে যাবে।

আকাশের অবস্থায় অনেক ভয়াবহ হবে।আকাশ ফেটে বিদীর্ণ হয়ে যাবে এবং টকটকে রক্তিম বর্ণ ধারণ করবে। আকাশের
বিচূর্ণ খন্ডগুলো তুলোর মতো উড়তে থাকবে। (সুরা তুর : ৯; সুরা আর-রহমান : ৩৭)। নক্ষত্র-তারকার অবস্থায় অনেক
ভয়াবহ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্যকে নিষ্প্রভ করা হবে। নক্ষত্রগুলো খসে খসে পড়বে। পাহাড়গুলো উড়তে থাকবে।
গর্ভবতী উটনীকে উপেক্ষা করা হবে। বন্য পশু একত্র করা হবে। সমুদ্র উত্তাল হবে।’ (সুরা তাকভির : ১-৬)। আল্লামা
বাগাবি (রহ.) বলেন, ‘ঘর-বাড়ি-প্রাসাদ সব ধসে ধসে পড়তে থাকবে। দুগ্ধবতী নারীদের দুধ বের হয়ে যাবে। গর্ভবতীদের
গর্ভপাত হয়ে যাবে। শিশুরা শুভ্রকেশ বৃদ্ধ হয়ে যাবে।

শয়তান ভয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পালাতে থাকবে। মানুষজন ছোটাছুটি করতে থাকবে। কিন্তু বড় বড়
গর্তের ভেতর পড়ে যাবে। এ দেখে পেছনের লোকেরা ভয়ে অন্য দিকে দৌড়াতে শুরু করবে।’ (আল-বুহুরুজ জাখিরাহ :
৫৮৩)। এভাবে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।

 

ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার পর একমাত্র আল্লাহ থাকবেন:
মহাবিশ্বের সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কেবল থাকবেন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ!কোরআনে এসেছে, ‘প্রত্যেকটি জিনিসই
ধ্বংস হয়ে যাবে। থাকবেন কেবল আল্লাহ।’ (সুরা কাসাস : ৮৮)। তখন আল্লাহ বিশাল শূন্যে মহাশূন্যে বজ্রনিনাদে ঘোষণা করবেন‘আজ বাদশাহি ও রাজত্ব কার?’ কোথাও কোনো সাড়াশব্দ হবে না।
তখন আল্লাহ বলবেন ‘একমাত্র পরাক্রমশালী প্রভু আল্লাহর।’ (সুরা গাফের : ১৬)। হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে উমর
(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কেয়ামতের সে সময় আল্লাহ সাত আসমান ও জমিনকে মুঠোর মধ্যে গুটিয়ে নেবেন।
তারপর ডান হতে পেঁচিয়ে ধরে ঘোষণা করবেন আমিই বাদশাহ! কোথায় পৃথিবীর বাদশাহরা? পরাক্রমশালীরা?
অহঙ্কারীরা? তারপর বাম হাতে পেঁচিয়ে ধরে একই ভাবে আবার ঘোষণা করবেন (মুসলিম : ২৭৮৮)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কিয়ামতের সময় উপস্থিত হওয়ার আগে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন-যাপন
করার তাওফিক দান করুন। কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়ের যাবতীয় ভয়াবহতা থেকে হিফাজত করুন। আমিন।