ইয়াজুজ মাজুজ এর পরিচয়:
উলামাদের কেউ কেউ বলেন, আরবী আজ শব্দ থেকে ইয়াজুজ মাজুজ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে; যার অর্থ হচ্ছে দ্রুতগামী; ইয়াজুজ মাজুজ যখন পৃথিবীতে বের হবে; তখন তারা খুব দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তাদের এই দ্রুতগামীতার
জন্য তাদেরকে ইয়াজুজ মাজুজ বলা হয়; আবার কারো কারো মতে; আরবী মওজ শব্দ থেকে ইয়াজুজ মাজুজ শব্দের
উৎপত্তি; যার অর্থ হচ্ছে তরঙ্গ বা ঢেউ। ইয়াজুজ মাজুজ যখন পৃথিবীতে বের হবে; তখন তারা এতো বেশি সংখ্যক হবে যে;
তারা তরঙ্গ বা ঢেউয়ের মতো ছুটতে থাকবে; এবং সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করবে। এজন্য তাদেরকে এই নামে নামকরণ
করা হয়েছে। সঠিক কথা এটা হতে পারে যে; আজ শব্দ থেকে ইয়াজুজ আর মওজ শব্দ থেকে মাজুজ শব্দের উৎপত্তি;
যার অর্থ হচ্ছে দ্রুতগামী ও তরঙ্গ। ইয়াজুজ মাজুজ যখন বের হবে; তখন তারা খুব দ্রুত ছুটে চলবে তরঙ্গের আকারে।
তাই তাদেরকে ইয়াজুজ মাজুজ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ইয়াজুজ মাজুজ পৃথক কোন সম্প্রদায় নয়:
বরং তারা আদম (আঃ)-এর বংশধর (বুখারী হা/৪৭৪১ মুসলিম হা/২২২)। মানুষের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য এদের সৃষ্টি
করা হয়েছে। তারা পৃথিবীতে কখন ও কিভাবে আগমন করেছে, এ বিষয়ে বিদ্বানদের মাঝে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
তবে তারা অবশ্যই আদম সন্তান ছিল বর্তমানে যুলক্বারনাইন নির্মিত প্রাচীর দ্বারা তারা আবেষ্টিত রয়েছে
(কাহফ ১৮/৯৪-৯৮)।
ইয়াজূজ ও মাজূজ মানব জাতিরই অংশ। তারা নূহ (আঃ)-এর ছেলে ইয়াফেছের বংশধর। তারা মানুষ হিসাবে জন্ম নিলেও মুসলিম নয়। কারণ তারা বিশ্বের অন্যান্য মানুষের মত ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদেরও ধ্বংসের চেষ্টায় থাকবে (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ৬/১০৪; আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী, ফায়যুল বারী ৪/৩৫৪। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে, যুলক্বারনাইন প্রাচীর নির্মাণের সময় কিছু ইয়াজূজ ও মাজূজ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আর তিনি তাদের আর্মেনিয়া অঞ্চলে ছেড়ে দেন।
তারাই হল তুর্কী (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ৬/৩৮৬)। ইয়াজূজ-মাজূজের নিকট বিশেষ কোন নবী-রাসূল প্রেরণের
বিষয়টি জানা যায় না। তবে তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর পরেও তারা যে ইসলাম গ্রহণ করেনি তা প্রমাণ করে
কিছু হাদীছ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন ডাক দিয়ে বলবেন হে আদম! নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেন যে, আপনি আপনার সন্তানদের মধ্য হতে জাহান্নামীদের বের করে দেন। আদম বলবেন,
হে আমার প্রতিপালক! কতজন জাহান্নামী? আল্লাহ বলবেন প্রতি হাযারে ৯৯৯ জন।… এ বক্তব্য লোকদের জন্য খুবই
কঠিন হ’ল। এমনকি তাদের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, দেখ ইয়াজূজ-মাজূজ সম্প্রদায়
থেকে হবে ৯৯৯ জন। আর তোমাদের মধ্য থেকে হবে ১ জন। (বুখারী হা/৪৭৪১; মিশকাত হা/৫৫৪১ ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ)।
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় উছায়মীন (রহঃ) বলেন, এই হাদীছ স্পষ্ট করে দেয় যে, ইয়াজূজ মাজূজ আদমের বংশধর আর তারা জাহান্নামী (লিক্বাউল বাবিল মাফতূহ ৬০/২৬)।
কিয়ামতের আগে ইয়াজুজ মাজুজ এর আবির্ভাব:
এ দুজাতির বেরিয়ে আসাটা ক্বিয়ামতের দশটি বড় আলামতের একটি (মুসলিম হা/২৮৮০; তিরমিযী হা/২১৮৩;
আবুদাউদ হা/৪৩১১)। ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে তাদের বংশধররা আল্লাহর হুকুমে প্রাচীর ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে। তারা সামনে
যা পাবে সব খেয়ে ফেলবে। তাদের সাথে কেউ লড়াই করতে সাহস পাবে না। তারা বহু লোককে হত্যা করবে। সমুদ্রের
পানি পান করে শেষ করবে। এক সময় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের এক পাহাড়ে উঠে তারা হুংকার দিয়ে বলবে, দুনিয়াতে যারা
ছিল সব শেষ করেছি, এখন আসমানে যারা আছে তাদের শেষ করব। এই বলে তারা আকাশে তীর ছুঁড়তে থাকবে। আল্লাহ
তাদের তীরে রক্ত মাখিয়ে ফেরত পাঠাবেন। অত:পর হজরত ঈসা আঃ ও তাঁর সাথীগণ তাদের উপর বদ-দোয়া করবেন;
যার ফলে ইয়াজুজ মাজুজ ও তাঁর দলবল সকলেই মারা যাবে, ও লাশ সমূহ পচে দুর্গন্ধ হবে। আল্লাহ তখন শকুন পাঠাবেন।
তারা লাশগুলিকে ‘নাহবাল’ নামক স্থানে নিক্ষেপ করবে। মুসলমানেরা তাদের তীর-ধনুকগুলি সাত বছর ধরে জ্বালানী
হিসাবে ব্যবহার করবে (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪৭৫)। কুরআনে তাদের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মাজুজকে বন্ধন মুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে।’
(সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৯৬)
হজরত নাওয়াস ইবনে মাসআ’ন (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. দাজ্জালের কথা উল্লেখ করেন। এতে আরো রয়েছে,
‘যখন আল্লাহ তাআলা হজরত ঈসা (আঃ) এর নিকটে অহি করে বলবেন, আমি আমার এমন বান্দাদের বের করব;
যাদের হত্যা করার মত কেউ নেই। অতএব, আমার বান্দাদেরকে তূর পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বল। এরপর আল্লাহ
তাআলা ইয়াজুজ ও মাজুজ জাতিদ্বয়কে প্রেরণ করবেন এবং তারা প্রত্যেকে উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে। আল্লাহর
নবি ঈসা (আঃ) ও তাঁর সাথীদের অবরুদ্ধ করা হবে। তখন তাদের নিকট একটি গরু আজ তোমাদের কারো নিকটে একশত দিনারের চেয়েও উত্তম হবে। অতপর আল্লাহর নবি ঈসা (আঃ) ও তাঁর সাথীগণ মুক্তি চাইবেন। তখন আল্লাহ তাদের ঘাড়ে
এক প্রকার কীট প্রেরণ করবেন। আর তারা সকলে একসাথে প্রভাত করবে মৃত্যুবরণ করে। অতপর আল্লাহর নবি ঈসা (আঃ)
ও তাঁর সাথীগণ জমিনে অবতরণ করবেন। (মুসলিম)
ইয়াজুজ মাজুজ ধ্বংস হবে ঈসা (আঃ) এর মাধ্যমে:
হজরত ঈসা (আঃ) ও তাঁর সাথীগণ জমিনে অবতরণের পর তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। অতপর আল্লাহ পাখী
প্রেরণ করবেন এবং তারা ইয়াজুজ ও মাজুজদেরকে বহন করে আল্লাহ তাআলা যেখানে চাইবেন সেখানে নিয়ে ফেলে দিবে।
ইয়াজুজ মাজুজের মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি বষর্ণ করে পৃথিবীকে ধৌত করে দিবেন। অতপর জমিনে বরকত নাজিল
হবে; শাক-সবজি ও ফল-ফলাদি উৎপাদিত হবে এবং শস্যাদি ও পশুতে বরকত নাজিল হবে।
কিয়ামত পূর্ববর্তী সময়ের ভয়াবহ পরিস্থিতির অবস্থায় আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইয়াজুজ মাজুজের অত্যাচার
নির্যাতন ও ভয়বাহ অবস্থা থেকে হিফাজত করুন। আমিন।