যুগযুগ ধরে হাদীস, উসূলে হাদীস, ফিক্বহ, উসূলে ফিক্বহ এবং হাদীসের ব্যাখ্যা ও হাদীসের বর্ণনাকারীদের ইতিহাসের কিতাব সমূহের ভাষ্য মতে, যারা হাদীসের সনদ ও মতন (বর্ণনাকারী ও মূল বিষয়) নিয়ে নিবেদিত এবং হাদীস শরীফের সংরক্ষণ, হিফাযত, সঠিক বুঝ এর অনুসরণ-অনুকরণে নিজের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদেরকেই আহলে হাদীস বা
আছহাবুল হাদীস বলা হয়। চাই সে হানাফী হোক বা শাফেয়ী , মালেকী অথবা হাম্বলী। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা যাকে
লা-মাযহাবীরাও অনুসরণ করে থাকে , তিনি বলেন-শুধু মাত্র হাদীস শ্রবণ, লিখন অথবা বর্ণনায় সীমাবদ্ধ ব্যক্তিদেরকেই
“আহলে হাদীস” বলা হয় না; বরং আমাদের নিকট “ আহলে হাদীস” বলতে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের বুঝায় যারা হাদীস সংরক্ষণ , পর্যবেক্ষণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থ অনুধাবন করার যোগ্যতা সম্পন্ন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অর্থের অনুসারী হবে।”
{নাক্বদুল মানতিক, পৃ. ১৮ কায়রো থেকে প্রকাশ ১৯৫১ইং}
আল্লামা হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আল-অজীর (মৃ.৮৪০ হিজরী) লিখেন- “একটি জ্ঞাত কথা হল “আহলে হাদীস”
বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে খেদমত করেছেন এবং এর অন্বেষণে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।”
উভয়ের বক্তব্যের দ্বারা এ কথাই পরিস্ফুটিত হয় যে, আহলে হাদীস হতে হলে হাদীস সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে নিবেদিতপ্রাণ
হতে হবে। ফিক্বহে হাদীস তথা হাদীসের মর্মকথা অনুধাবণ করতে হবে, আর আমল করতে হবে সে অনুযায়ী। চাই সে যে মাযহাবেরই হোক না কেন।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও আশ্চর্যের বিষয় হল যে, লা-মাযহাবীরা “আহলে হাদীস” বলতে মাযহাব অমান্যকারী একটি দল
ও একটি নির্দিষ্ট মতবাদ বুঝায়। অনুরূপভাবে যেথায়ই আহলে হাদীস বা আহলুল হাদীস শব্দ দেখতে পাওয়া যায় এর দ্বারা
তারা নিজেদেরকেই মনে করে। চাই সে জাহেল বা মূর্খ হোক, নামাযী হোক বা বেনামাযী হোক হাদীস সম্বন্ধে তার কোন
জ্ঞান থাক বা না থাক। কেবল আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই আহলে হাদীস উপাধি পেয়ে যাবে। {আখবারুল ইত্তেছাল, পৃ.৫ কলাম-১, সংখ্যা-২ ফে. ১৯৬২ আহলে হাদীসের তদানিন্তন সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা ইসমাইল কর্তৃক প্রকাশিত।}
তাই এ দলের সবার উপাধি “আহলে হাদীস”
যদিও তাদের অনেকেরই পেটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেও একটি হাদীস নির্গত হবে না। উপরন্তু তাদের দলীয় আলেমদের অনেকেই ফিক্বহে হাদীস সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞানও রাখে না, বুঝার চেষ্টাও করে না। এর প্রমাণ হিসেবে তাদের নেতা নবাব
ছিদ্দিক হাসান খানের উক্তি পেশ করছি- “আপনি তাদেরকে কেবল হাদীসের শব্দ নকল করতে দেখবেন, হাদীস বুঝার প্রতি
তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করে না। এতটুকু তারা নিজেদের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করে। অথচ এ ভ্রান্ত ধারণা মূল লক্ষ্য থেকে
অনেক দূরে, কেননা হাদীসের কেবল শব্দের গ-ীতে সীমাবদ্ধ না থেকে হাদীস বুঝা, এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে গবেষণা করাই হল
মূল উদ্দেশ্য”। { আল-হিত্তাহ ফী যিকরিচ্ছিহাহ ছিত্তাহ পৃ.৫৩}
তিনি আরো লিখেন- “তাদের মধ্যে যদি নিষ্ঠা থাকতো তাহলে প্রথাগত আহলে হাদীস আর নামে মাত্র কুরআন-কিতাবের
অনুসারী হওয়াই যথেষ্ট মনে করতো না।” {আল-হিত্তাহ-পৃ.১৫৬}
উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, আহলে হাদীস দলে ভর্তি হলেই বা এ মতবাদ গ্রহণ করলেই অথবা আহলে
হাদীস নাম করণেই প্রকৃত অর্থে “আহলে হাদীস” হওয়া যায় না। বরং এর জন্য চাই অসীম ত্যাগ ও পরিপূর্ণ যোগ্যতা। আরও
বুঝা গেল যে, বর্তমানে যাদের নাম “আহলে হাদীস” তারা কাজে ও বাস্তবে আহলে হাদীস নয়, তাদের নামে আর কাজে
কোন মিল নেই। কেবল সরলমনা সাধারণ মুসলমানগণকে প্রতারণার জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ হিসেবে এ নামটি গ্রহণ করেছে। যেমন-জামের ন্যায় কালো মানুষের নামও অনেক সময় লাল মিয়া বা সুন্দর আলী রেখে থাকে।
হাদীস সংকলনের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হাদীস, তাফসীর, ফিক্বহ ও ইলমে হাদীস সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়
এবং হাদীসের ব্যাখ্যামূলক অসংখ্য কিতাব রচিত হয়ে আসছে। আর উম্মতে মুসলিমার নিমিত্তে এ মহান খিদমাত মুজতাহিদ ইমাম অথবা তাদেরই মুকাল্লিদ উলামায়ে কিরামের অসীম ত্যাগ তিতীক্ষার ফলাফল। যা প্রতিটি জ্ঞানী মুসলিম মাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য।
ছিহাহ ছিত্তাহ সহ হাদীসের যাবতীয় কিতাবের সংকলকগণ মুক্বালিদ তথা কোন না কোন মাযহাবের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। যদিও
কোন কোন মাসআলায় আপন মাযহাবের খেলাফও করেছেন। যেমন ইমাম ত্বাহাবী হানাফী হওয়া সত্বেও কোন কোন
মাসআলায় হানাফী মাযহাবের ভিন্ন মতও অবলম্বন করেছেন।
আহলে হাদীস দাবি করলেই হাদীসের অনুসারী হওয়া যায়?
যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে দাবি করে এবং এ দলের নির্ধারিত ফরম পূর্ণ করলেই “আহলে হাদীস” নামের
সার্টিফিকেট লাভে ধন্য হয় (!) হাদীস তথা ইলমে হাদীসের জগতে তাদের কোন অবদান নেই কেন? তারা মাযহাব মানাকে
শিরক বলে, সুতরাং তাদের ভাষ্য মতে মাযহাব মানে এমন মুশরিকদের সংকলিত হাদীসের কিতাব সমূহের উপর তাদের
আস্থা ও নির্ভরতা হয় কোন হাদীসের ভিত্তিতে? তাই আমি তাদেরকে বলব লা-মাযহাবী হিসাবে আপনাদের মাযহাব অবলম্বী
কারও মাধ্যম ব্যতীত হাদীস বর্ণনা করতে হবে। তবেই হাদীসের ক্ষেত্রে “আহলে হাদীসের” দৌরাত্ম্য ও চাতুরী ধরা পড়বে।
আর মুসলমানরা বুঝতে সক্ষম হবে যে, “আহলে হাদীস” নামের অন্তরালে ইসলামপ্রিয় সাধারণ মুসলমানদেরকে দ্বীন থেকে সরানোর দুরভিসন্ধি আর ঈমান হরণের গভীর ষড়যন্ত্র বৈ আর কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। সব কিছু মিলিয়ে একথা বলতে
পারি যে, তাদের এ নাম অবলম্বন, লবণের কৌটায় চিনি আর বিষের বোতলে মধুর লেবেল লাগানোরই নামান্তর।
সালাফী দাবির বাস্তবতা:
সালাফী শব্দটির মূল হচ্ছে “সালাফ”,যা সাধারণতঃ অতিবাহিত বা পূর্ববর্তী অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। {আল-মু’জামূল
অসিত-পৃ.৪৪৩} আর যারা অতিবাহিত বা পূর্ববর্তীদের অনুসরণ-অনুকরণ করে তারাই হলো “সালাফী”। যেহেতু ইসলামী ইতিহাসের প্রথম তিন যুগের মহামনীষীগণ, অর্থাৎ সাহাবা (রা.) তাবেঈন ও তাবে তাবেয়ীগণই রাসূল (সা.) এর ভাষায়
পূর্বসূরী হওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট ও প্রকৃত অধিকারী। তাই, যে তাঁদের অনুসৃত আদর্শ ও ব্যাখ্যার আলোকে কুরআন হাদীসকে
আঁকড়ে ধরবে সে-ই হবে সত্যিকারার্থে সালাফী তথা পূর্ববর্তীদের অনুসারী।
সাহাবী ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন-” আমার সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত,
আমার যুগের উম্মত। অতঃপর শ্রেষ্ঠ উম্মত তাঁরা , যারা সাহাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে (তাবেয়ীগণ) অতঃপর শ্রেষ্ঠ উম্মত
তাঁরা, যারা ২য় যুগের উম্মত। তথা তাবেয়ীগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে, (তাবেয়ীনগণ) অতঃপর এমন জনগোষ্ঠির আগমন
ঘটবে যারা সাক্ষ্য দিলে তা গ্রহণ করার উপযুক্ত হবে না, আমাদের জন্য বিশ্বস্ত হবেনা, অঙ্গীকার রক্ষা করবে না, এক
কথায় তাদের মধ্যে কেবল অসৎ ও অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকবে”। { বুখারী শরীফ ফাজায়েলে
সাহাবা-হা.৩৬৫০ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেখুন ফাতহুল বারী পৃ.৭/৬ }
এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী ইতিহাসে অনুসরণীয় পূর্ববর্তী স্বর্ণযুগ বলতে উপরোল্লেখিত তিনটি য্গুই বুঝায়। আর
এ তিন যুগের সমাপ্তি ঘটেছে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর সূচনালগ্নে। অতএব সাহাবা, তাবেয়ী, ও তদসংশ্লিষ্ট আইম্মায়ে
মুজতাহিদগণই আমাদের যোগ্য পূর্বসূরী। তাই কুরআন-হাদীসের সঠিক মর্ম অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ, মতামত
ও ব্যাখ্যার অনুসরণ যারা করবে একমাত্র তাঁরাই সালাফী দাবি করার অধিকার রাখে। আর যারা তাঁদের অনুসরণ করে না বা
তাঁদের প্রতি বিরাগ ও বৈরী ভাব পোষণ করে অথবা তাঁদের পরবর্তী নিকৃষ্টতম যুগের কারও অনুসরণ করে তারা কোন ক্রমেই সালাফী দাবি করার অধিকার রাখে না।
আহলে হাদীস নামদারী সালাফীদের সালফে ছালেহীনদের সাথে কতটুকু সম্পর্ক?
তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের পকেট পুস্তিকা ও চ্যালেঞ্জ-বিবৃতিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, “যারা পবিত্র কুরআন
ও হাদীসের ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজে নিবে তারাই সালাফী বা আহলে হাদীস , তারাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল, জান্নাতের অধিকারী।” {দ্র:আহলে হাদীস আন্দোলন কি ও কেন-পৃ.৪-১৩}
তাদের এ বক্তব্য বাহ্যত খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই ধরা পড়বে যে তারা অত্যন্ত চাতুরতার
সাথে বিষ মিশ্রণ করে দিয়েছে। কেননা তাদের এ বক্তব্যে সাহাবায়ে কিরামগণের অনুসৃত আদর্শও যে দ্বীন ও শরীয়তের
অন্তর্ভূক্ত এ কথাকে অতি ধূর্ততার সাথে অস্বীকার করা হয়েছে।
কথিত আহলে হাদীস আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিব তার লিখিত “আহলে হাদীস আন্দোলন
কি ও কেন” পুস্তিকার প্রথম থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত, বিশেষ করে ৪ ও ১৩ নং পৃষ্ঠায় এ কথাই বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে,
আহলে হাদীস আন্দোলন পূর্বসূরী কোন ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য করা নয় বরং একমাত্র কুরআন-হাদীসেরই ইত্তিবা’ করা।
এ জন্যই এ আহলে হাদীস নামক মতবাদের পরিচয় দিতে যেয়ে ভারতবর্ষের অন্যতম হাদীস বিশারদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ
মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) লিখেন- “তারা না ক্বিয়াস মানে , না সাহাবা ও তাবেয়ীদের অনুসৃত আদর্শ- উক্তি মানে, যেমন
মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন দাউদে যাহেরী ও ইবনে হাযাম যাহেরী।”{হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ-পৃ.১/১৬১}
আসল সালাফীদের পরিচয়:
অথচ রাসূল (সা.) এর হাদীস হলো- “আমার তরীক্বা এবং আমার পরবর্তী সত্যের আলোকবর্তিকা হিদায়াতপ্রাপ্ত সাহাবাদের তারীক্বা আঁকড়ে ধরা তোমাদের জন্য একান্ত জরুরী।”{তিরমিযী, কিতাবুল ইলম,বাবু মা-জায়া ফিল আখজে বিসসুন্নাহ
পৃ.৫/৪৩ হা. নং(২৬৭৬)}
মুক্তিপ্রাপ্ত একটি দলের পরিচয় দিতে যেয়ে প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ ফরমান- “আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে,
কেবল একটি মাত্র দল ব্যতীত অপরাপর সবাই দোযখী হবে, সাহাবায়ে কিরামগণ আরজ করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! মুক্তিপ্রাপ্ত
এ দলটির পরিচয় কি? তদুত্তরে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যারা আমার এবং আমার সাহাবাদের তরীক্বার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে”{ তিরমিযী, কিতাবুল ইলম, হা.নং-(২৬৪১)।
লক্ষণীয় যে, প্রথমোক্ত হাদীসে মহানবী (সা.) তাঁর তরীক্বার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবাদের তরীক্বাকেও আঁকড়ে ধরতে নির্দেশ করেছেন। তেমনি ভাবে দ্বিতীয় হাদীসেও মহানবী (সা.) তাঁর তরীক্বায় প্রতিষ্ঠিতদেরকে যেমনিভাবে মুক্তিপ্রাপ্ত দলে গণ্য করেছেন অনুরূপ ভাবে সাহাবাদের (রা.) তরীক্বা বা আদর্শে প্রতিষ্ঠিতদেরকেও মুক্তিপ্রাপ্ত দলেই গণ্য করেছেন। তাই উপরোক্ত হাদীস দু’টি এবং এ ধরনের আরও অসংখ্য হাদীসের আলোকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবাগণের তরীক্বা বা অনুসৃত আদর্শ আমাদের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়, তাঁরাই আমাদের প্রথম সারির “সালাফ” বা পূর্বসূরী। সুতরাং যারা তাঁদের অনুসরণ করবে তারা সালাফী। আর যারা তাঁদের অনুসরণ করবে না তারা “সালাফী” দাবি করার অধিকার রাখেনা। বরং তারা “খেলাফী” বা বিরুদ্ধাচরণকারী।