আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনা।

‘আসমানী কিতাব বলতে এমন কতকগুলো গ্রন্থকে বোঝানো হয়, ইসলাম ধর্মমতে মুসলমানগণ যে গ্রন্থগুলোকে আল্লাহ্প্রদত্ত গ্রন্থ বলে বিশ্বাস করেন। ইসলাম ধর্মে যে ৭টি বিষয়ের উপর বিশেষ করে ঈমান আনতে বা বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়েছে
তার মধ্যে একটি বিষয় হলো এই আসমানী কিতাব, যেগুলো সরাসরি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়।

আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের অন্যতম রুকন। আসমানী কিতাবগুলোর প্রতি ঈমান আনার
অর্থ হলো দৃঢ় বিশ্বাস করা যে এগুলো সত্য ও সঠিক। আরো বিশ্বাস করা যে, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার কালাম। তাতে রয়েছে হিদায়াত, নূর এবং যাদের প্রতি এগুলো নাযিল করা হয়েছে, তাদের জন্য এগুলোই যথেষ্ট।

আসমানী কিতাবগুলো থেকে আল্লাহ তা‘আলা যেগুলোর নাম উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি। যেমন কুরআন, তাওরাত, ইঞ্জিল ও যবুর। আর যেগুলোর নাম আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেন নি,
সেগুলোর প্রতিও বিশ্বাস করি। কেননা আল্লাহ তা‘আলার আরো অনেক কিতাব রয়েছে, যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানে না।

মানুষের বিবেক-বুদ্ধি যেহেতু সীমিত এবং সেটা দ্বারা ক্ষতিকর ও কল্যাণকর বস্তুর মধ্যে পার্থক্য মোটামুটিভাবে বুঝতে সক্ষম হলেও তারা কল্যাণকর ও ক্ষতিকর বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে জানতে সক্ষম নয়। তাই তাদের জন্য আসমান থেকে কিতাব পাঠানোর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি দয়াশীল হয়ে নবী-রসূলদের মাধ্যমে অনেক কিতাব পাঠিয়েছেন।

 

আসমানী কিতাবসমূহের অস্তিত্ব:

লাওহে মাহফুজে সমস্তআসমানী কিতাব বিদ্যমান থাকলেও পৃথিবীর বুকে একমাত্র কুরআন ছাড়া অন্যান্য আসমানী
কিতাব অনুপস্থিত। বর্তমানে কুরআন ছাড়া আসমানী কিতাবের নামে যে সকল কিতাব পাওয়া যায়, তার কোনটাই মূল ভাষা
ও অর্থে সুরক্ষিত নেই। বরং সেগুলোতে রয়েছে ব্যাপক রদবদল। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন- یُحَرِّ فُونَ ٱلْكَلِمَ عَن مَّوَ اضِ عِھِ
“তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে।” (সূরা আল-মায়েদা : ১৩) বুখতে নসর নামক একজন প্রতাপশালী ইয়াহূদীর শাসনামলে তাওরাত গ্রন্থ সম্পূর্ণ রূপে বিলীন হয়ে যায়। তখন লোকদের যা মুখস্থছিল তা লিপিবদ্ধ করে তার মধ্যে নিজেদের সুবিধামত রদবদল করে নিয়ে জনৈক বাদশাহ এটা ধংস করে দিরে ইয়াহূদী আলিমগণ তা জোড়াতালি দিয়ে একীভূত করে আরএর মধ্যেও নিজেেেদর অনেক নতুন নতুন ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি সংকলিত করে তার নাম দেয়।

আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান চারটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে:

এক) সুদৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, সবগুলো আসমানী কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। বাস্তবে
আল্লাহ তাআলা এই বাণীসমূহ দিয়ে কথা বলেছেন। এ বাণীসমূহের মধ্যে কোনটি ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়া পর্দার আড়াল
থেকে সরাসরি আল্লাহর নিকট হতে শ্রবণীয়। এর মধ্যে কোনটি ফেরেশতার মাধ্যমে রাসূলের নিকট পৌঁছেছে। এর মধ্যে
কোনটি আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করেছেন। “আল্লাহ কোন মানুষের সাথে কথা বললে বলেন ওহীর মাধ্যমে
অথবা পর্দার আড়াল থেকে অথবা কোন দূত পাঠানোর মাধ্যমে; যে দূত আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তিনি যা চান সে ওহী
পৌঁছে দেন। নিশ্চয় তিনি মহীয়ান, প্রজ্ঞাময়।”[সূরা আশ্‌ শুরা, আয়াত: ৫১] আল্লাহ আরো বলেন: “আর আল্লাহ মূসার
সাথে সরাসরি কথাবলেছেন।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১৬৪]
দুই) এ কিতাবসমূহের মধ্যে আল্লাহ তাআলা যেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করেছেন সেগুলোর প্রতি বিস্তারিতভাবে
ঈমান আনা। এ ধরনের কিতাবগুলো হচ্ছে- কুরআন, তওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর, সহিফায়ে ইব্রাহিম ও সহিফায়ে মূসা। এ কিতাবগুলোর কথা আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আর আল্লাহ যে কিতাবগুলোর কথা এজমালিভাবে উল্লেখ করেছেন আমরা সে কিতাবগুলোর প্রতি এজমালিভাবে ঈমান আনব। ঠিক যেইভাবে আল্লাহ আমাদেরকে ঈমান আনার
নির্দেশ দিয়েছেন- “বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।”[সূরা শুরা, আয়াত: ১৫]
তিন) এ কিতাবসমূহে উল্লেখিত যে সংবাদগুলো সহিহ সনদে জানা গেছে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা। যেমন কুরআনের সংবাদসমূহ। অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের যে সংবাদগুলোতে পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটেনি সে
সংবাদসমূহের প্রতি ঈমান আনা।
চার) এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তাআলা কুরআনকে সকল কিতাবের উপর ফয়সালাকারী ও সত্যায়নকারীরূপে
প্রেরণ করেছেন। “আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সত্যায়নকারী (মুসাদ্দিক) ও তদারককারীরূপে (মুহাইমিন)।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৮] তাফসিরকারগণ বলেন, মুহাইমিন অর্থ হচ্ছে- কুরআনের পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের উপর ফয়সালাকারী, সাক্ষী ও সত্যায়নকারী। অর্থাৎ সে কিতাবসমূহে যা কিছু সত্য
কুরআন তার সত্যায়ন করবে এবং যা কিছুতে বিকৃতি, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং
সে কিতাবসমূহের বিধানাবলীকে রহিত করবে; তথা পূর্ববর্তী বিধানসমূহ উঠিয়ে দিবে অথবা নতুন বিধিবিধান আরোপ
করবে।
আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান আনার মাধ্যমে বান্দার  লাভ:
উম্মতে মুহাম্মাদির প্রতিটি সদস্যের কর্তব্য হচ্ছে- প্রকাশ্যে ও গোপনে এই কুরআনের অনুসরণ করা, কুরআনকে
আঁকড়ে ধরা, কুরআনের হক আদায় করা। ঠিক যেভাবে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন- “এটি এমন একটি গ্রন্থ, যা
আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়। অতএব, এর অনুসরণ কর এবং ভয় কর-যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।”[সূরা
আনআম, আয়াত: ১৫৫] কুরআন আঁকড়ে ধরা ও কুরআনের হক আদায় করার অর্থ হচ্ছে- কুরআন যা কিছুকে হালাল
ঘোষণা করেছে সেগুলোকে হালাল হিসেবে গ্রহণ করা, কুরআনের নির্দেশের প্রতি অনুগত হওয়া, ধমকির বিষয়াবলী হতে
দূরে থাকা, দৃষ্টান্তসমূহ থেকে উপদেশ গ্রহণ করা, কাহিনীসমূহ হতে শিক্ষা গ্রহণ করা, মুহকাম আয়াতের জ্ঞান অর্জন করা, মুতাশাবিহ আয়াতের প্রতি আত্মসমর্পন করা, কুরআন নির্ধারিত সীমারেখায় থেমে যাওয়া, কুরআন রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে
তোলা, কুরআন মুখস্ত করা, তেলাওয়াত করা, এর আয়াতাবলী নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা, রাতদিন কুরআন দিয়ে নামায
পড়া, কুরআনের কল্যাণে কাজ করা, ইলমের ভিত্তিতে কুরআনের দিকে দাওয়াত দেয়া। আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমানার মাধ্যমে বান্দা অনেকগুলো উপকার লাভ করে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার অত্যধিক গুরুত্বের বিষয়টি অবহিত হওয়া। তাইতো তিনি
প্রত্যেক কওমকে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আলাদা আলাদা কিতাব পাঠিয়েছেন। ২. শরিয়ত বা আইন আরোপের ক্ষেত্রে
আল্লাহ তাআলার হেকমত সম্পর্ক জানা। তাইতো তিনি প্রত্যেক কওমের পরিবেশ-পরিস্থিতির উপযোগী শরিয়ত (আইন)
প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন: “আমি তোমাদের প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি।”।[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৪৮]
৩. আল্লাহ তাআলার এই মহান নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। ৪. কুরআন তেলাওয়াত, কুরআন গবেষণা, কুরআনের
অর্থ বুঝা ও সে অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে কুরআনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা। দেখুন: আলামুস সুন্নাহ আল-মানশুরা (৯০-৯৩) এবং শাইখ উছাইমীনের উসুল ছালাছা এর ব্যাখ্যা (৯১, ৯২)।
আসমানী কিতাবের সংখ্যা:
শরহে উমদাতুল ক্বারী গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আসমানী কিতাবের সংখ্যা ১০৪ খানা। যেমনহযরত আবু যার গিফারী
(রা) হতে বর্ণিত। সে সকল রাসূলের প্রতি আল্লাহর বাণী কিতাব ও সহীফা আকারে নাযিল হয়েছে, এ কিতাব এবং সহীফার
সর্বমোট সংখ্যা ১০৪ খানা। এ সকল আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে সহীফা বা ছোট কিতাব ১ শ খানা। হযরত শীছ (আ)
এর প্রতি ৫০ খানা, হযরত ইদরীস (আ)-এর প্রতি ৩০ খানা। হযরত ইবরাহীম (আ) প্রতি ১০ খানা এবং হযরত আদম (আ)
এর প্রতি ১০ খানা অবতীর্ণ হয়েছিল।” বাকি ৪ খানা হল প্রধান এবং প্রসিদ্ধ আসমানী কিতাব। এ ৪টি প্রধান আসমানী
কিতাব পর্যায়ক্রমে, তাওরাত বনী ইসরাইলকে হিদায়াতের জন্য হযরত মুসা (আ)-এর প্রতি; যাবুর হযরত দাউদ (আ)
এর প্রতি; ইনজীল হযরত ঈসা (আ)-এর প্রতি এবং বিশ্ব মানবতার হিদায়াতের জন্য সর্বশেষ ও পূর্ববর্তী
সমস্তকিতাব রহিতকারী ‘আল-কুরআন’ সর্বশেষ নবী ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়।
মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার হাত থেকে হিফাজত করুন, আমীন।