অহংকার মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা
বেশী। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে।
অহংকারের আরবী নাম কিব্র (الْكِبْر)। যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড়
মনে করাই এর অন্তর্নিহিত অর্থ। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান
করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। নিম্নের হাদীছে এর পরিণতি ও ব্যাখ্যা দু’টিই
বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল ছাঃ এরশাদ করেছেন,
“ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার অন্তরে কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে।
জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকেরা চায় যে, তার পোষাক সুন্দর হোক , তার জুতা
সুন্দর হোক । জবাবে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন।
অহংকার হল সত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা’।
এর অর্থ হ’ল সত্য জেনেও মিথ্যার উপরে দৃঢ় থাকা এবং নানারূপ দোহাই দিয়ে
সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা। আর ‘অন্যকে তুচ্ছ মনে করা’ অর্থ সর্বদা নিজেকে অন্যের
চেয়ে বড় মনে করা এবং অন্যের কাছে নিজের মূল্যায়ন কামনা করা। তার চাহিদা
মতে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়াতেই সে অন্যকে হেয় জ্ঞান করে।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ রহঃ বলেন, ‘অহংকার শিরকের চেয়েও নিকৃষ্ট।
কেননা অহংকারী ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের বিরুদ্ধে অহংকার করে। আর মুশরিক
আল্লাহর ইবাদত করে এবং সাথে অন্যেরও করে’।
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম রহঃ বলেন, সমস্ত পাপের উৎস হল তিনটি : (১) অহংকার,
যা ইবলীসের পতন ঘটিয়েছিল। (২) লোভ, যা জান্নাত থেকে আদম-কে বের করে
দিয়েছিল। (৩) হিংসা, যা আদম (আঃ)-এর এক সন্তানের বিরুদ্ধে অপর সন্তানকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছিল। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি বস্ত্তর অনিষ্ট থেকে বেঁচে
থাকতে পারবে সে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। কেননা কুফরীর মূল
উৎস হল অহংকার। পাপকর্মের উৎস হল লোভ। আর বিদ্রোহ ও সীমালংঘনের
উৎস হল হিংসা। অহংকার ও আত্মম্ভরিতা দু’টিই বড়াই ও বড়ত্বের একক উৎস
থেকে উৎসারিত। বস্ততঃ এই রোগে যে আক্রান্ত হয়, সে নিজেকে নিজে ধ্বংস করে।
তার দ্বারা সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি নিজ পরিবারও ধ্বংস হয়।
(১) দম্ভভরে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা : এটাই হল প্রধান নিদর্শন। যা উপরের হাদীছে
বর্ণিত হয়েছে।
(২) নিজেকে সর্বদা অন্যের চাইতে বড় মনে করা : যেমন ইবলীস আদমের চাইতে
নিজেকে বড় মনে করেছিল এবং আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল। মানব সমাজেও যারা
অনুরূপ অবাধ্য ও শয়তানী চরিত্রের অধিকারী, তারা সমাজে ও সংগঠনে এভাবেই
ধিকৃত ও বহিষ্কৃত হয়। তবে যারা আল্লাহর জন্য বিতাড়িত ও নির্যাতিত হন, তারা
ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হন।
(৩) অন্যের সেবা ও আনুগত্য করাকে নিজের জন্য অপমানজনক মনে করা :
এই প্রকৃতির লোকেরা সাধারণতঃ উদ্ধত হয়ে থাকে।
(৪) নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করা : শক্তিশালী ব্যক্তি, সমাজনেতা, রাষ্ট্রনেতা,
যেকোন পর্যায়ের পদাধিকারী ব্যক্তি বা কর্মকর্তা ও ধনি শ্রেণীর কেউ কেউ অনেক
সময় নিজেকে এরূপ ধারণা করে থাকে। সে ভাবতেই পারে না যে, আল্লাহ যেকোন
সময় তার কাছ থেকে নে‘মত ছিনিয়ে নিতে পারেন। আবু জাহল এরূপ অহংকার করেছিল। সে রাসূল ছাঃ কে তার বিরাট দল ও শক্তিশালী জনবলের ভয় দেখিয়েছিল।
তার পরিণতি অবশেষে কি হয়েছিল, সবার জানা। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘কখনই না। মানুষ অবশ্যই সীমালংঘন করে’। ‘কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে’ (আলাক্ব ৯৬/৬-৭)। ফলে প্রত্যেক মানুষই পরস্পরের মুখাপেক্ষী। কেউ অভাবমুক্ত নয়। তাই মানুষের জন্য অহংকার শোভা পায় না। আল্লাহ কেবল ‘মুতাকাবিবর’। ‘অহংকার তাঁর চাদর’ তাই অহংকার কেবল
তাঁরই জন্য শোভা পায়।
(৫) লোকদের কাছে বড়ত্ব যাহির করা ও নিজের ত্রুটি ঢেকে রাখা: মূসা (আঃ) যখন ফেরাঊনকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর নিদর্শন দেখালেন, তখন ফেরাঊন ভীত হ’ল।
কিন্তু নিজের দুর্বলতা ঢেকে রেখে সে তার লোকদের জমা করে ভাষণ দিয়ে বলল,
‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা’। ‘ফলে আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের
শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৩-২৪)।
বস্তত ফেরাঊনী চরিত্রের লোকের অভাব সমাজে নেই। সমাজ দুষণের জন্য এসব লোকেরাই প্রধানতঃ দায়ী।
(৬) অন্যকে নিজের তুলনায় ছোট মনে করা : মূসা ও হারূণ আঃ ফেরাঊনের কাছে
গেলে তারা বলেছিল, আমরা কি এমন দু’ব্যক্তির উপরে বিশ্বাস স্থাপন করব যারা
আমাদেরই মত এবং তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে’ (মুমিনূন ২৩/৪৭)।
মক্কার কাফের নেতারাও রাসূল ছাঃ এর নিকট থেকে বেলাল, খোবায়েব, ছুহায়েব,
ইবনু মাসঊদ প্রমুখ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সরিয়ে দিতে বলেছিলেন, যাতে তারা তাঁর
সঙ্গে বসে কথা বলতে পারেন। তখন আয়াত নাজিল হয়েছে ‘যেসব লোক সকাল-
সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের ইবাদত করে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে সরিয়ে দিয়ো না। তাদের কোন আমলের হিসাব তোমার দায়িত্বে
নেই এবং তোমার কোন আমলের হিসাব তাদের দায়িত্বে নেই। এরপরেও যদি তুমি
তাদের সরিয়ে দাও, তাহ’লে তুমি যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৫২)।
ধনে-জনে ও পদমর্যাদায় নিম্নস্তরের লোকদের প্রতি মনের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব
উদ্রেক হওয়াটা অহংকারের লক্ষণ। অতএব এই স্বাভাবিক রোগ কঠিনভাবে দমন
করা অবশ্য কর্তব্য।
(৭) মানুষের সাথে অসদ্ব্যবহার করা ও তাদের প্রতি কঠোর হওয়া : এটি অহংকারের অন্যতম লক্ষণ। হযরত আয়েশা রাঃ বলেন, একদিন জনৈক ব্যক্তি রাসূল ছাঃ এর সাক্ষাৎপ্রার্থী হল। তিনি বললেন, তোমরা ওকে অনুমতি দাও। সে তার গোত্রের কতই
না মন্দ ভাই ও কতই না মন্দ পুত্র! অতঃপর যখন লোকটি প্রবেশ করল, তখন রাসূল ছাঃ তার সাথে অতীব নম্রভাবে কথা বললেন। পরে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি লোকটি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলেন। আবার সুন্দর
আচরণ করলেন, ব্যাপারটা কি? জবাবে তিনি বললেন, হে আয়েশা! ‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট
সেই ব্যক্তি যাকে লোকেরা পরিত্যাগ করে ও ছেড়ে যায় তার ফাহেশা কথার ভয়ে’।
(৮) শক্তি বা বুদ্ধির জোরে অন্যের হক নষ্ট করা : এটি অহংকারের একটি বড় নিদর্শন। আল্লাহ কাউকে বড় করলে সে উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে তিনি বড় হয়েছেন
ও যিনি তাকে বড় করেছেন সেই বান্দা ও আল্লাহকে সে ভুলে যায়। সে এই কথা ভেবে অহংকারী হয় যে, আমি আমার যোগ্যতা বলেই বড় হয়েছি। ফলে সে আর অন্যকে
সম্মান করে না। সে তখন শক্তির জোরে বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অন্যের হক
নষ্ট করে। এই হক সম্মানের হতে পারে বা মাল-সম্পদের ও হতে পারে।
অহংকার এর অন্যতম নিদর্শন
(৯) অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা ও তাদেরকে নিকৃষ্টভাবে খাটানো : অহংকারী মালিকেরা তাদের অধীনস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের প্রতি এরূপ আচরণ করে থাকে।
যা তাদের জাহান্নামী হবার বাস্তব নিদর্শন। এই স্বভাবের লোকেরা এভাবে প্রতিনিয়ত
হককুল ইবাদ নষ্ট করে থাকে
রাসূল ছাঃ বলেন, ‘তুমি মযলূমের দো‘আ থেকে বেঁচে থাক। কেননা মযলূমের দো‘আ
ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই । রাসূল ছাঃ বলেন, ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই
হকদারকে তার হক আদায় করে দেয়া হবে।
(১০) মিথ্যা বা ভুলের উপর যিদ করা : এটি অহংকারের অন্যতম নিদর্শন। নবীগণ
যখন লোকদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতেন, তখন তারা বাপ-দাদার দোহাই
দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করত এবং নিজেদের ভুল ও মিথ্যার উপরে যিদ করত। যদিও
শয়তান তাদেরকে (এর মাধ্যমে) জ্বলন্ত অগ্নির শাস্তির দিকে আহবান করে ।
কেবল কাফেরদের মধ্যে নয়, বরং মুসলমানদের মধ্যেও উক্ত দোষ পরিলক্ষিত হয়।
যেমন শিরক ও বিদ‘আতে অভ্যস্ত লোকেরা বিভিন্ন অজুহাতে উক্ত পাপের উপর
টিকে থাকে। অমনিভাবে বিচারক ও শাসক শ্রেণী তাদের ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে
আসেন না। বরং একটি অন্যায় প্রবাদ চালু আছে যে, ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। অথচ মানুষের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
অহংকারে এর কারণসমূহ
১. ভাল-র প্রতি হিংসা : আসমানে প্রথম এ হিংসা করেছিল ইবলীস। সে আদমের
উচ্চ মর্যাদার প্রতি হিংসাবশে তাকে সিজদা করেনি। এই হিংসাকে সে যুক্তির
আড়ালে লুকিয়ে রেখে বলেছিল, ‘আমি তার চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে
আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬)।
অতঃপর যমীনে প্রথম হিংসা করেছিল ক্বাবীল তার ভাই হাবীল-এর প্রতি। কারণ
হাবীলের কুরবানী আল্লাহ কবুল করেছিলেন। কিন্তু ক্বাবীলের কুরবানী তিনি কবুল
করেননি। অথচ এতে হাবীলের কোন হাত ছিল না। এ বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
এখানেও ছিল ভাল-র প্রতি হিংসা। যুগে যুগে এটা জারি আছে। যেজন্য নবী-রাসূলগণ
ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ সর্বদা দুষ্টুদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও অহংকারীরা সর্বদা নিজেদের সাফাই গেয়ে মিথ্যা বলে থাকে। কথায় বলে, ‘এক হাতে তালি বাজে না’। কথাটি অনেক ক্ষেত্রে সত্য হলেও আল্লাহভীরু সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের বেলায় তা খাটে না। উপরের দৃষ্টান্তগুলিই তার প্রমাণ।
২. মালের আধিক্য :
অধিক ধন-সম্পদ মানুষকে অনেক সময় অহংকারী করে তোলে। মাল ও সন্তান
মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু মানুষ অনেক সময় এর দ্বারা ফেৎনায় পতিত হয়
এবং অহংকারে স্ফীত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ ক্বারূণের কথা বর্ণনা
করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘ক্বারূণ ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আমি তাকে এমন ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিসমূহ বহন করা একদল শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের পছন্দ করেন না।’ … ‘সে বলল, এ সম্পদ
আমি আমার জ্ঞান বলে প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ সে কি জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চাইতে শক্তিতে প্রবল ছিল এবং সম্পদে প্রাচুর্যময় ছিল। আর অপরাধীদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না (তারা সরাসরি জাহান্নামে যাবে)’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৬, ৭৮)।
ক্বারূণী ধন সবাই পেতে চায়। কিন্তু তা মানুষকে অহংকারী করে তোলে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে।
দু’ধরনের মানুষ ইলমে অহংকার করে
৩. ইলম : ইলম অনেক সময় আলেমকে অহংকারী বানায়। দু’ধরনের লোকের মধ্যে
এটা দেখা যায়। জন্মগতভাবে বদ চরিত্রের লোকেরা যখন ইলম শিখে, তখন ইলমকে তার বদস্বভাবের পক্ষে কাজে লাগায়। এইসব আলেমরা কুরআন-হাদীছের অপব্যাখ্যা করে
এবং নিজেকে অন্যদের তুলনায় বড় আলেম বলে যাহির করে। এদের মধ্যে ইলম থাকলেও সেখানে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি থাকে না।
দ্বিতীয় কারণ হল, অল্প বিদ্যা। যেমন কিছু ইলম শিখেই নিজেকে অন্যের তুলনীয় মনে
করা এবং বলা যে, هُمْ رِجَالٌ وَنَحْنُ رِجَالٌ ‘তারাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ’। আমরা ও
তারা সমান। এটা তাদের অহংকারের পরিচয়।
প্রকৃত ইলম হল সেটাই যা মানুষকে বিনয়ী ও আল্লাহভীরু বানায়। ইমাম মালেক বিন
আনাস কে ৪৮ টি প্রশ্ন করা হলে তিনি ৩২ টি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, لاَ أَدْرِي ‘আমি জানি না’।
অতএব আল্লাহকে চেনা ও জানা এবং আল্লাহভীতি অর্জন করাই হল ইলম হাছিলের
মূল লক্ষ্য। আল্লাহভীতি সৃষ্টি হলেই বাকী সবকিছুর জ্ঞান তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
৪. পদমর্যাদা :
উচ্চ পদমর্যাদা মানুষের মধ্যে অনেক সময় অহংকার সৃষ্টি করে। মূর্খরা এটাকে তাদের
হীন স্বার্থে ব্যবহার করে। জ্ঞানীরা এর মাধ্যমে মানব কল্যাণে অবদান রাখেন। পদমর্যাদা একটি কঠিন জবাবদিহিতার বিষয়। যিনি যত বড় দায়িত্বের অধিকারী, তাকে তত বড় জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। রাসূল ছাঃ বলেন, মনে রেখ, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক তার প্রজাসাধারণের দায়িত্বশীল। তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। ব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল।
সে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর গৃহ ও সন্তানাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। চাকর তার মনিবের মাল-সম্পদ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।
যে ব্যক্তি পদমর্যাদা বা দায়িত্ব পেয়ে অহংকারী হয় এবং পদের অপব্যবহার করে,। মূলতঃ যুলুম-খেয়ানত সবকিছুর উৎপত্তি হয় পদমর্যাদার অহংকার থেকে। অতএব পদমর্যাদা
যেন মনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি না করে; বরং দায়িত্বের জন্য কৈফিয়ত দেয়ার ভয়ে হৃদয় যেন সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে, আল্লাহর নিকট সর্বদা সেই তাওফীক কামনা করতে হবে।
বংশ মর্যাদা আর আমলের অহংকার
৫. বংশ মর্যাদা: বংশ মর্যাদা মানুষের উচ্চ সম্মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মানদন্ড।
এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে, যতক্ষণ বংশের লোকেরা বিনয়ী ও চরিত্রবান থাকে। উক্ত দু’টি
গুণ যত বৃদ্ধি পায়, তাদের সম্মান তত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যদি সেখানে কথায় ও আচরণে দাম্ভিকতা প্রকাশ পায়, তাহলে কচুর পাতার পানির মত উক্ত সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়।
সঙ্গত কারণে বিশেষ অবস্থায় বংশ মর্যাদাকে ইসলাম গুরুত্ব
দিয়েছে। যেমন
(ক) বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে
(খ) রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। যেমন পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইঙ্গিত
দিয়ে রাসূল ছাঃ বলেন, ‘নেতা হবেন কুরায়েশ থেকে’। তাঁর মৃত্যুর পরে খলীফা নির্বাচন নিয়ে মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলে উক্ত হাদীছটির মাধ্যমে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। (গ) যুদ্ধকালীন সময়ে। যেমন হোনায়েন যুদ্ধে
রাসূল ছাঃ খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, أَنَا النَّبِىُّ لاَ كَذِبْ ، أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ ‘আমিই নবী মিথ্যা নই। আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র।
এখানে তিনি আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের নেতার পুত্র হিসাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন।
এর দ্বারা তিনি শত্রুদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি বুক দিতে জানি, পিঠ দিতে জানি না।
৬. ইবাদত ও নেক আমল :
ইবাদত ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলেও তা অনেক সময় মুমিনের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে। যা তাকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করে। বহু নেককার ও ইবাদতগুযার ব্যক্তি অলি-আউলিয়া, গাউছ-কুতুব-আবদাল, পীর-মাশায়েখ ইত্যাদি লকবে অভিহিত হন। তারা ভক্তের ভক্তি রসে আপ্লুত হতে ভালবাসেন। যা তাদের মধ্যে লোভ ও অহংকার সৃষ্টি করে।
সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও নিজের ভুলের উপর যিদ ও হঠকারিতার বিষয়টি বেশী দেখা যায় শিরক-বিদ‘আত ও তাকলীদপন্থী লোকদের মধ্যে, নেতাদের মধ্যে এবং মূর্খ ও ধর্মান্ধ লোকদের মধ্যে। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই গর্বিত থাকে।অথচ সব অহংকারই ধূলায় মিশে যাবে আল্লাহর একটি ‘কুন’ শব্দে। অতএব হে মানুষ! অহংকারী হয়ো না, বিনয়ী হও। উদ্ধত হয়ো না, কৃতজ্ঞ হও। অতীত ভুলো না, সামনে তাকাও।