অহংকার এর পরিণতি ও দূরীকরণের উপায়:

পরিণতি : দুনিয়াতে অহংকারের পরিণতি হল লাঞ্ছনা। আর আখেরাতে এর পরিণতি
হল ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের পুঁজ-রক্ত পান করা। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার সৃষ্টি হবে, তার জ্ঞান ততটুকু হ্রাস পাবে। যদি কারো অন্তরে অহংকার স্থিতি
লাভ করে, তবে তার জ্ঞানচক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। বোধশক্তি লোপ পায়। সে অন্যের
চাইতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কাম্য সম্মান না পেলে সে মনোকষ্টে মরতে বসে।
তার চেহারায় ও আচরণে, যবানে ও কর্মে অহংকারের দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। ফলে
মানুষ তার থেকে ছিটকে পড়ে। এক সময় সে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। একাকীত্বের যন্ত্রণায়
সে ছটফট করতে থাকে।
অহংকার মানুষের ভিতরে লুকায়িত একটা বিষের নাম। একে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না।
কিন্তু একে দমিয়ে রাখতে হবে, যেন মাথা উঁচু করতে না পারে। যেমন ঝাড়িয়ে
সাপের বিষ নামাতে হয়। মনের মধ্যে এই বিষ-এর উদয় হলেই বুদ্বুদের মত একে
হাওয়া করে দিতে হবে। তাই কেবল অহংকার দূরীকরণের আকাংখাই যথেষ্ট নয়,
বরং এ রোগের রীতিমত চিকিৎসা ও প্রতিষেধক প্রয়োজন। নিম্নে বর্ণিত হল
১. নিজের সৃষ্টি ও মৃত্যুর কথা সর্বদা স্মরণ করা : মানুষ তার জন্মের সময় উল্লেখযোগ্য
কিছুই ছিল না। মৃত্যুর পর সে লাশে পরিণত হবে। আর মৃত্যুর ঘণ্টা সর্বদা তার মাথার
উপর ঝুলে আছে। হুকুম হলেই তার রূহ যার হুকুমে তার দেহে এসেছিল তার কাছেই
চলে যাবে। তার প্রাণহীন দেহটা পড়ে থাকবে দুনিয়ায় পোকার খোরাক হবার জন্য।
অতএব মানুষের জন্য অহংকার করার মত কিছু নেই। কেননা সে তার রোগ-শোক.
বার্ধক্য-জ্বরা কিছুকেই প্রতিরোধ করতে পারে না। শতবার ঔষধ খেলেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার রোগ সারে না। শত চেষ্টাতেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার বিপদ দূরীভূত
হয় না। ফলে সে একজন অসহায় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং তার উচিত সর্বদা নিরহংকার ও বিনয়ী থাকা।
২. আখেরাতে জবাবদিহিতার ভয়ে ভীত হওয়া : ক্বিয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমলনামা
তার হাতে দিয়ে আল্লাহ বলবেন, ‘তোমার আমলনামা তুমি পাঠ কর। আজ তোমার
হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট’ (ইসরা ১৭/১৪)। অতঃপর যখন তারা স্ব স্ব
আমলনামা দেখবে, তখন সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন
উপস্থিত করা হবে প্রত্যেকের আমলনামা। অতঃপর তাতে যা আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতংকিত। এ সময় তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! এটা
কেমন আমলনামা যে, ছোট-বড় কিছুই বাদ যায়নি, সবকিছুই লিখে রেখেছে। তারা
তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক কারো প্রতি
যুলুম করেন না’ (কাহফ ১৮/৪৯)।
অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে নে‘মত দিয়েছেন ও দুনিয়াবী দায়িত্ব প্রদান করেছেন, আল্লাহর নিকট তার যথাযথ জবাবদিহিতার কথা সর্বদা স্মরণ করতে হবে এবং কিভাবে সে
দায়িত্ব আরও সুন্দরভাবে পালন করা যায়, তার জন্য সর্বদা চেষ্টা করবে।

অহংকার থেকে বাচতে নিজেকে ও আল্লাহকে জানা:

৩. নিজেকে জানা ও আল্লাহকে জানা : প্রথমেই নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে হবে যে,
মৃত শুক্রাণু থেকে সে জীবন পেয়েছে। আবার সে মরবে। অতএব তার কোন অহংকার নেই। কেবল বিনয় ও আনুগত্য কাম্য। অতঃপর আল্লাহ সম্পর্কে জানবে যে, তিনিই
তাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। তিনিই তাকে শক্তি দিয়ে মেধা দিয়ে পূর্ণ
পরিণত মানুষে পরিণত করেছেন। অতএব প্রতি পদে পদে আল্লাহর দাসত্ব ব্যতীত
তার কিছুই
করার নেই। অতএব নিজেকে সর্বদা আল্লাহর দাস মনে করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অহংকার বিদূরণের প্রধান ঔষধ।
৪. যেসব বিষয় মনে অহংকার সৃষ্টি করে, সেগুলি সম্পর্কে চিন্তা করা যে, এগুলিতে অহংকার করার মত কিছু নেই। যেমন বংশের অহংকার, ধনের অহংকার, পদমর্যাদার অহংকার, বিশেষ কোন নে‘মতের অহংকার। এগুলি সবই আল্লাহর দান। তিনি যেকোন সময় এগুলি ফিরিয়ে নিতে পারেন। আমরা হর-হামেশা এগুলো দেখতে পাচ্ছি যে, বহু জ্বালাময়ী বক্তা সুস্থ থেকেও নির্বাক হয়ে আছেন, বহু লেখক লুলা হয়ে গেছেন, বহু ধনী
নিঃস্ব হয়েছেন, বহু নেতা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। বহু শক্তিমান পুরুষ প্যারালাইজড
হয়ে বা স্ট্রোক হয়ে বা বার্ধক্যে জরজর হয়ে পড়ে আছেন। তাদের অসহায় চেহারাগুলি চিন্তা করলেই নিজের মধ্য থেকে অহংকার নিমেষে হারিয়ে যাবে।
৫. ইচ্ছাকৃতভাবে জনহীতকর কাজ করা :
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল ছাঃ নিজের জুতা নিজে ছাফ করতেন, কাপড় সেলাই করতেন ও বাড়িতে বিভিন্ন কাজ করতেন, যেমন তোমরা করে থাক। তিনি বলেন, রাসূল
ছাঃ অন্যান্য মানুষের ন্যায় একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কাপড়ের উকুন বাছতেন, ছাগী দোহন করতেন এবং নিজের অন্যান্য কাজ করতেন। অতএব সাধ্যে কুলায় এমন
যেকোন জনহীতকর কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে পারলে মনের মধ্য থেকে সহজে অহংকার দূর হয়ে যাবে। যেমন আপনি অফিসের বস। টেবিলের ধূলা নিজে মুছলেন, মাকড়সার জালগুলো নিজে দূর করলেন, প্রয়োজনে টয়লেট ছাফ করলেন, এমনকি ঘরটা ঝাড়ু দিলেন। এসব ছোটখাট কাজ হলেও এগুলির মাধ্যমে অহংকার
দূর হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যের নিকট সম্মান বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি নিজের কাজ নিজে
করায় রাসূল ছাঃএর সুন্নাত অনুসরণের ছওয়াব পাওয়া যায়।

আল্লাহকে হাযির নাযির মানা:

৬. আল্লাহ আমার সব কাজ ও কথা দেখছেন শুনছেন, দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস পোষণ করা :
আল্লাহ বলেন,‘মনে রেখ দুজন গ্রহণকারী ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বামে বসে সর্বদা
তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’। ‘সে মুখে যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য
সদা তৎপর প্রহরী তার নিকটেই অবস্থান করে’ (ক্বাফ ৫০/১৭-১৮)।
৭. গরীব ও ইয়াতীমদের সঙ্গে থাকা ও রোগীর সেবা করা : রাসূল ছাঃ বলেন, তোমরা
আমাকে দুর্বলদের মধ্যে তালাশ কর’। জনৈক ব্যক্তি রাসূল ছাঃ কে তার অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ পেশ করলে তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি ইয়াতীমের মাথায় হাত
বুলাও এবং অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান কর।
বস্তত যেকোন সেবামূলক কাজ যদি নিঃস্বার্থ হয় এবং পরকালীন লক্ষ্যে হয়, তবে
সেগুলি অহংকার চূর্ণ করার মহৌষধ হিসাবে আল্লাহর নিকট গৃহীত হয় এবং বান্দা জাহান্নাম থেকে বেঁচে যায়।
৮. নিজের সৎকর্মগুলি আল্লাহর নিকট কবুল হচ্ছে কি-না সেই ভয়ে সর্বদা ভীত থাকা :
হযরত আয়েশা রাঃ বলেন, আমি রাসূল ছাঃ কে নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করলাম, ‘আর যারা তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত অন্তরে। এজন্য
যে, তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে’। ‘তারা দ্রুত সম্পাদন করে তাদের
সৎকর্ম সমূহ এবং তারা সেদিকে অগ্রগামী হয়’ (মুমিনূন ২৩/৬০-৬১)। আমি বললাম,
এরা কি তারাই যারা মদ্যপান করে ও চুরি করে? তিনি বললেন, ‘না হে ছিদ্দীকের কন্যা!
বরং এরা হল তারাই যারা ছিয়াম রাখে, ছালাত আদায় করে ও ছাদাক্বা করে এবং তারা
সর্বদা ভীত থাকে এ ব্যাপারে যে, তাদের উক্ত নেক আমলগুলি কবুল হচ্ছে কি-না।
তারাই সৎকর্ম সমূহের প্রতি দ্রুত ধাবমান হয়’।
৯. ভুলক্রমে বা উত্তেজনা বশে অহংকার প্রকাশ পেলে সাথে সাথে বান্দার কাছে,
অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
রাসূল ছাঃ বলেন, ‘যদি কেউ তার ভাইয়ের সম্মানহানি করে বা অন্য কোন বস্তর
ব্যাপারে তার প্রতি যুলুম করে, তবে সে যেন তা আজই মিটিয়ে নেয়। সেদিন আসার
আগে, যেদিন কোন দীনার ও দিরহাম তার সঙ্গে থাকবে না।

অহংকারী বেষ বুষা পরিহার করা

১০. অহংকারী পোষাক ও চাল-চলন পরিহার করা : পোষাক স্বাভাবিক ও সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন হতে হবে। কেননা আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন। কিন্তু স্বাভাবিক পোষাকের  বাইরে অপ্রয়োজনে আড়ম্বরপূর্ণ কোন পোষাক পরিধান করা ‘রিয়া’-র
পর্যায়ে পড়ে  যাবে। যা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। যাতে অনেকে ফেৎনায় পড়েন
ও তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি হয়।
১১. গোপন আমল করা : নিরহংকার ও রিয়ামুক্ত হওয়ার অন্যতম পন্থা হ’ল গোপন
আমল করা। গোপনে ছাদাক্বা করা এমনভাবে যে ডান হাত যা ব্যয় করে, বাম হাত তা জানতে পারে না এবং ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর দু’চোখ
বেয়ে  অশ্রু প্রবাহিত হয়’।
১২. আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা : যদি কেউ আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে পারে, তবে তার চোখের পানিতে অহংকার ধুয়ে-মুছে ছাফ হয়ে যাবে। রাসূল ছাঃ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না। যেমন দুধ পুনরায় পালানে প্রবেশ করে না’। তিনি বলেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহ’লে তোমরা কাঁদতে বেশী, হাসতে কম।
১৩. মানুষকে ক্ষমা করা ও সর্বদা নম্রতা অবলম্বন করা : রাসূল ছাঃ বলেন, ‘বান্দা কাউকে ক্ষমা করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর যখন সে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয় অবলম্বন করে, তখন তিনি তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেন’ । এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিনয় ও আনুগত্য মানুষকে উঁচু ও সম্মানিত করে। পক্ষান্তরে অহংকার ও আত্মগর্ব মানুষকে নীচু ও লাঞ্ছিত করে।
১৪.নিরহংকার হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা :
অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিম্নের দো‘আটি পাঠ করা যেতে পারে।-
اللهُ أَكْبَرُ كَبِيراً وَالْحَمْدُ لِلَّهِ كَثِيراً وَسَبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ مِِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ-
অর্থ : আল্লাহ অতি মহান, আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা, সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর
প্রশংসাসহ আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা। আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি বিতাড়িত শয়তান হ’তে এবং তার প্ররোচনা, তার ফুঁক ও তার কুমন্ত্রণা হ’তে।
(১) যখন মানুষ মিথ্যা ছেড়ে সত্যের অনুসারী হয়, তখন সে তার জন্য অহংকার
করতে পারে। যেমন কুফর ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করা। (২) যদি কেউ জাল ও যঈফ
হাদীছ ছেড়ে ছহীহ হাদীছের উপর আমল শুরু করে, তবে তার জন্য সে গর্ব করতে
পারে। (৩) যখন কোন ব্যক্তি ফিরক্বা নাজিয়াহর সাথী হয়, তখন সে ঐ জামা‘আতের
উপর গর্ব করতে পারে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়,
সে যেন জামা‘আতবদ্ধ জীবনকে অপরিহার্য করে নেয়’।
উপসংহার :
হাফেয যাহাবী বলেন, অহংকারের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রকার হ’ল ইলমের অহংকার। কেননা তার ইলম তার কোন কাজে আসেনা। যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য জ্ঞানার্জন
করে, জ্ঞান তার অহংকারকে চূর্ণ করে দেয় এবং তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে।
যে নিজেকে হীন মনে করে এবং সর্বদা নিজের হিসাব নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। একটু উদাসীন হ’লেই ভাবে এই বুঝি ছিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হ’লাম ও ধ্বংস হয়ে গেলাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম শিখে গর্ব করার জন্য ও নেতৃত্ব লাভের জন্য, সে অন্যের উপর অহংকার করে ও তাদেরকে হীন মনে করে। আর এটিই হ’ল সবচেয়ে বড় অহংকার ।
পরিশেষে বলব, জাত-পাত, দল-মত ও যাবতীয় মিথ্যা অহংকার ছেড়ে আল্লাহ প্রেরিত মহাসত্যের দিকে ফিরে আসা এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা আল্লাহর সৃষ্টি
হিসাবে প্রত্যেক মানুষের জন্য কর্তব্য। বান্দার কোন অহংকার থাকলে তা হবে কেবল সত্যের অহংকার। অন্য কিছুর নয়। আল্লাহ আমাদেরকে মিথ্যা অহমিকা ও তার কুফল হতে রক্ষা করুন- আমীন!